শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের দুর্নীতি-অনিয়মের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এলাকার প্রতিবন্ধী, বিধবাদের মতো অসহায় মানুষজন। ওই কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপকারভোগী বিধবা-প্রতিবন্ধীদের ভাতা নানা কারসাজি করে আত্মসাতে লিপ্ত রয়েছে।
English
হোম অনলাইনসারাবাংলা ‘বিধবা ভাতা তুলবার গেলে কয়, আমি নাকি মইরা গেছি’
‘বিধবা ভাতা তুলবার গেলে কয়, আমি নাকি মইরা গেছি’
শ্রীবরদী সমাজসেবা কার্যালয়ে কারসাজি
রেজাউল করিম বকুল শ্রীবরদী (শেরপুর) ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১১:২৯ শেয়ার মন্তব্য()প্রিন্ট
‘বিধবা ভাতা তুলবার গেলে কয়, আমি নাকি মইরা গেছি’
অ- অ অ+
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের দুর্নীতি-অনিয়মের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এলাকার প্রতিবন্ধী, বিধবাদের মতো অসহায় মানুষজন। ওই কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় উপকারভোগী বিধবা-প্রতিবন্ধীদের ভাতা নানা কারসাজি করে আত্মসাতে লিপ্ত রয়েছে।
হালেমা বেগম নামে ভুক্তভোগী অশীতিপর এক বিধবা আক্ষেপ করে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘১০ বছর ধইর্যা বিধবা ভাতা পাইতাছি। অহন হেরা কয়, আমি নাকি মইরা গেছি। তাই আর ভাতা পামু না। ’
হালেমা বেগমের এই আক্ষেপের সূত্র ধরে কয়েক দিন ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে শ্রীবরদী উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের নানা অপকর্মের তথ্য। জানা যায়, উপজেলার ভেলুয়া ইউনিয়নের কাউনেরচর চকবন্দী গ্রামের মৃত ফজলুল হকের স্ত্রী হালেমা ১০ বছর ধরে সরকারের বিধবা ভাতা পেয়ে আসছেন। তাঁর বিধবা ভাতার কার্ড নম্বর ৩৪১৭। চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বিধবা ভাতা নেওয়ার জন্য সম্প্রতি তিনি উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে যান। এ সময় ভাতা দেওয়ার কথা বলে দালালচক্রের সদস্য একই গ্রামের আদর আলী তাঁর কাছ থেকে কার্ড নিয়ে নেন। কিন্তু ওই দিন অন্য সবাইকে ভাতা দিলেও হালেমাকে দেওয়া হয়নি।
হালেমা বেগম এই প্রতিবেদককে জানান, পরদিন আবার তিনি ওই কার্যালয়ে গেলে আদর আলী তাঁকে বলেন, তাঁর কার্ড নিয়ে ঝামেলা আছে। এ জন্য তাঁকে ভাতা দেওয়া হবে না। এ সময় ভেলুয়া ইউনিয়নের দায়িত্ব পালনকারী ইউনিয়ন সমাজকর্মী ছামিউল হক হালেমা বেগমকে বলেন, তাঁর নামে মৃত্যু সনদ জমা পড়েছে। তাই তাঁকে আর ভাতা দেওয়া হবে না।
হালেমা বেগম প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয়নি। সেখান থেকে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। পরে অন্য দালালদের মাধ্যমে জানতে পারেন, ইউনিয়ন সমাজকর্মী ছামিউল হক ও আদর আলী মিলে তাঁর টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
জানতে চাইলে হালেমা বেগম বলেন, ‘১০ বছর ধাইর্যা বিধবা ভাতা পাইতাছি। অহন হেরা কয় আমি মইরা গেছি। আপনারাই কন, এডা কেমনে অইলো? আমি মূখ্য মানুষ। তাই কিছুই কইতে পারছি না। ’
এদিকে ভেলুয়া গ্রামের আব্দুস সামাদের ছেলে দরিদ্র প্রতিবন্ধী আক্কাছ আলীর (৩৯) কাছ থেকে কার্ড কেড়ে নিয়ে তাঁর ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আক্কাছ আলী জানান, ২০১৬ সালে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী হিসেবে তাঁর নামে কার্ড হয়। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত বইয়ের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ভাতা তুলেছেন তিনি। এরপর টাকা দেওয়ার কথা বলে কৌশলে তাঁর কাছ থেকে ভাতার কার্ড হাতিয়ে নেন ইউনিয়ন সমাজকর্মী ছামিউল হক। তখন থেকে তাঁকে আর কোনো টাকা-পয়াসা দেওয়া হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী আক্কাছ আলীর ভাতার কার্ড হাতিয়ে নিয়ে নিজেই টাকা তুলে আত্মসাৎ করছেন ছামিউল হক।
এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আক্কাছ আলী বলেন, ‘আমার বউয়ের ট্যাহা তোলার অনুমতি ছিল। এই কার্ড দিয়ে কয়েকবার ট্যাহাও পাইছি। অহন কার্ড নিয়া আর ট্যাহা দেয় না। ’
আক্কাছ আলীর স্ত্রী রোজিনা বলেন, ‘আমার স্বামী প্রতিবন্ধী। আয়-ইনকাম করতে পারে না। প্রতিবন্ধী ভাতা আর ছাগল-মুরগি পালন করে কোনোমতে সংসার চালাই। মানুষের কাছে হাত পাততে পারি না। অফিসের লোক আর দালালরা ট্যাহা চাইছিল। দেই নাই দেইখ্যা আমগোর কার্ড কাইড়া নিছে। অহন খুব কষ্টে আছি। ’
এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের ভেলুয়া ইউনিয়নের দায়িত্ব পালনকারী ইউনিয়ন সমাজকর্মী ছামিউল হক বলেন, ছালেমা বেগম নামের একজনের মৃত্যু সনদ তাঁর কাছে এসেছে। ভুলবশত তিনি একে হালেমা বেগম বলে মনে করেছেন। তাই ওই সময় তাঁকে বিধবা ভাতার টাকা দেওয়া হয়নি। এখন বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ায় তিনি হালেমা বেগমকে তাঁর পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেবেন।
অসচ্ছল প্রতিবন্ধী আক্কাছ আলীর (৩৯) ভাতা দেওয়া বন্ধ করার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়ন সমাজকর্মী ছামিউল হক বলেন, অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। এ জন্য কার্ড জমা নেওয়া হয়েছে। হালনাগাদ সম্পন্ন হলে আক্কাছ আলী আবারও ভাতা পাওয়া শুরু করবেন।
হালেমা বেগম ও আক্কাছ আলীর বিষয়টি ভুল হয়েছে স্বীকার করে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সরকার নাছিমা আক্তার বলেন, ‘এটা আমরা ঠিক করে নেব। এখানে কাজ বেশি, লোক কম। তাই ভুল হতেই পারে। ’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেঁজুতি ধর বলেন, ‘আমার কাছে এখনো এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
সর্বশেষ গতকাল শনিবার জানা যায়, কয়েক দিন ধরে খোঁজখবর নেওয়ার মধ্যেই শ্রবরদী সমাজসেবা কার্যালয় থেকে ভুক্তভোগী দু-একজনকে ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সূত্রঃ কালেন কন্ঠ