তরুণীরাও ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে

তরুণীরাও ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে

পেশায় তিনি চিকিৎসক! পেশার উল্লেখ ছাড়া নিজের আর কোনো পরিচয় দিতে চাননি। অনেক সংগ্রাম করে, অনেক মূল্য দিয়ে মাদকাসক্তি থেকে এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।
মাদকাসক্তির জন্য ভালোবাসার সংসার ভেঙে গেছে। পরিবার থেকে একটা সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সহপাঠীদের থেকেও। তারা এখন অনেক উচ্চপর্যায়ে চলে গেছে, সমাজে অনেক খ্যাতি, সুনাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলছিলেন, ‘বুঝলেন, অনেক স্বপ্ন ছিল জীবনে। আমার নিজের, পরিবারের। সব নষ্ট হয়ে গেল। কত ভালো ছাত্র ছিলাম। স্কুলে ফার্স্ট হতাম। রাজেন্দ্র কলেজে আমার ব্যাচে সব থেকে ভালো রেজাল্ট হয়েছিল আমার। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলাম। তখন সিগারেট পর্যন্ত খেতাম না। পরে এই সিগারেটই সর্বনাশ করল। সিগারেটই হলো মাদকের গেটওয়ে।’
মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়ার কাহিনি বলতে গিয়ে তিনি জানালেন, গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে গেছেন। সবার মধ্যে একটু চোখে পড়া, একটু স্মার্ট হওয়ার প্রলোভন এবং কিছুটা চাপে পড়েও প্রথম জড়িয়ে পড়েছিলেন ছাত্ররাজনীতিতে। তারপর সঙ্গীদের সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে সিগারেটে টান। একপর্যায়ে হেরোইনে আসক্তি। পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়তে লাগলেন। বাড়িতে জানাজানি হলো। চরম অশান্তি শুরু হলো পরিবারে। তারপর যা হয়। নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি। আবার পড়ালেখা শুরু করা। কিছুদিন নেশা ছাড়া ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন ভালোবাসার মানুষকে। তারপর আবার জড়িয়ে পড়েন মাদকে। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আবার ভর্তি হলেন নিরাময় কেন্দ্রে। আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য এবার আরও দীর্ঘ সংগ্রাম। অবশেষে ফিরলেন অসম্ভব মনের জোরে। বাড়ির লোকেরাও অনেক সাহায্য করেছিলেন। ব্যাচেলর ডিগ্রি কোনো মতে শেষ করার পর প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষায় আর এগোতে পারেননি। বাড়ি ফিরে এসেছেন। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। বন্ধুবান্ধব সব ছেড়ে অফিস আর বাড়ি—এই হলো তাঁর প্রতিদিনের জীবনযাত্রা।
গত কয়েক দিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, ফরিদপুর শহরে তরুণ প্রজন্মের ভেতরে মাদকাসক্তির প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ইদানীং শহরের একশ্রেণির তরুণীও ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। স্থানীয় র্যা ব-৮-এর কোম্পানি অধিনায়ক মো. রইছউদ্দিন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে তাঁরা দেখেছেন একশ্রেণির তরুণী ইয়াবাতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। শহরের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সম্প্রতি ইয়াবা আসক্তি বেড়েছে। তিনি জানান, এসব মাদকাসক্ত তরুণ থেকেই তাদের বান্ধবীদের মধ্যে ইয়াবা আসক্তি ছড়াচ্ছে। প্রথমে তারা বিনা খরচায় সেবন করায়। তারপর আসক্ত হয়ে পড়লে অনেক সময় দেখা যায়, নিজেরাই নিজেদের ভেতরে খুচরা বেচাকেনায় জড়িয়ে পড়ে। সংক্রামক রোগের মতো ইয়াবার আসক্তি এভাবেই বেড়ে গেছে।
র্যা ব এ বছর প্রথম পাঁচ মাসে ৭০ জন মাদক বিক্রেতাকে আটক করেছে। মামলা হয়েছে ৮৪টি। এই সংখ্যা আগের দুই বছরের তুলনায় বেশি। ২০১৫ সালে মামলা হয়েছিল ৯২টি ও গ্রেপ্তার হয়েছিল ৬০ জন, গত বছর মামলা হয়েছে ৬৯টি আর গ্রেপ্তার হয়েছিল ৫৬ জন। এই আড়াই বছরে ৪৯ হাজার ৯৭৬টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার হয়েছে। র্যা বের অধিনায়ক জানান, সময়ের তুলনায় এই সংখ্যাটি কম মনে হতে পারে। এখানে চট্টগ্রামের মতো বড় আকারের চালান আসে না। খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে এসব বড়ি উদ্ধার করা হয়। সে কারণে তৃণমূল থেকে যদি এক হাজার বড়ি ইয়াবাও কোনো স্থানে উদ্ধার করা হয়, তবে তা অনেক বড় রকমের উদ্ধারের ঘটনা বলে মনে করা হয়। আর এ থেকে সেই এলাকায় আসক্তদের সংখ্যাও অনুমান করা যায়।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রাকিবুজ্জামানের মতেও ইয়াবাই এখন ফরিদপুরে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া মাদক। তাঁরা ২০১৫ থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৩১১টি মামলা করেছেন। আটক করেছেন প্রায় সমসংখ্যক বিক্রেতাকে। ইয়াবা পরিবহনে সুবিধা, লুকিয়ে রাখা সহজ এবং দামে ফেনসিডিলের চেয়ে অনেক সস্তা হওয়ায় মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
জেলা পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করছে। পুলিশ এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ৫৬৯টি মামলা করে ৬৫০ জন মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। ৪১ হাজার ২১১ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জেলা পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখানে এসে প্রথম যে কাজ করেছি, তা হলো মাদককে দুষ্প্রাপ্য করে তোলা। প্রতিটি থানায় নির্দেশ দিয়েছি, প্রতিদিন মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। প্রতিদিন মামলা করতে হবে। আমাকে প্রতিদিন রিপোর্ট করতে হবে। আমার টেবিলে রিপোর্ট থাকে। প্রতিদিন প্রথমেই আমি মাদক-সংক্রান্ত রিপোর্ট দেখে দিনের কাজ শুরু করি।’
জেলার সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি রমেন্দ্র নাথ রায় কর্মকার মনে করেন, ফরিদপুরে একসময় বাড়ি বাড়ি সংস্কৃতিচর্চা চলত, নিয়মিত অনুষ্ঠান হতো। এসব এখন প্রায় বন্ধ। তরুণ প্রজন্মের মাদকে জড়িয়ে পড়ার এটিও একটি কারণ। দলমত-নির্বিশেষে সবাই মিলে জেলায় মাদকের বিরুদ্ধে একটি বড় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
মাদক ব্যবসায়ীরা যেন সহজে জামিন না পায় সেই বিষয়টি আইনজীবীদের সতর্কতার সঙ্গে দেখার প্রতি জোর দিয়েছেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ফরিদপুর চ্যাপ্টারের সমন্বয়কারী শিপ্রা গোস্বামী।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::