ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি আয়োজিত জনসমাবেশ থেকে ৭ দফা, ১২ লক্ষ্য ও ২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। একইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ খ্যাত বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়েছে।
রবিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব দাবি ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
দলীয় চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ ও আলোচনার মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবি রয়েছে ঘোষিত ৭ দফায়।
এ ৭ দফা ও দাবি বাস্তবায়নে আগামী ৩ অক্টোবর দেশের সব জেলায় এবং ৪ অক্টোবর বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ ও স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
কর্মসূচি ঘোষণা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সরকার যদি দাবি মেনে না নেয় তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করা হবে। খালেদা জিয়ার ডাকে দেশবাসী এবং সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সরকার ভীষণ ভয়ে আছে। তারা এখন পদে পদে ষড়যন্ত্রের ভূত দেখতে শুরু করেছে।’
৭ দফা দাবি:
১. (ক) বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
(খ) একই সাথে সব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি, সাজা বাতিল ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার।
(গ) নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা।
(ঘ) পুরনো মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না।
(ঙ) কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সাংবাদিকদের ন্যায্য আন্দোলন এবং সামাজিক ও গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের অভিযোগে গ্রেফতার, ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তির নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
২. আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে।
৩. রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
৪. আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
৫. নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাদের ওপর কোনও ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ না করা।
৬. সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ নিশ্চিত করা। নির্বাচনের একমাস আগে থেকে নির্বাচনের পর ১০ দিন পর্যন্ত মোট ৪০ দিন সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখতে হবে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
৭. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর যুগোপযোগী সংশোধন করতে হবে।
১২ লক্ষ্য:
৭ দফা দাবি পেশ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী কী করবে সে বিষয়ে ১২টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো হল-
১. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা।
২. সব প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসানে জাতীয় ঐকমত্য গঠন।
৩. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলীয়করণের ধারার বদলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
৪. রাষ্ট্রক্ষমতায় গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
৫. স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা।
৬. স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে আরও আধুনিক, শক্তিশালী ও কার্যকর করা।
৭. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
৮. দুর্নীতি প্রতিরোধে দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথভাবে সংস্কার ও কার্যকর করা।
৯. সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা।
১০. সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- এ মূলনীতিকে অনুসরণ করে জাতীয় মর্যাদা এবং স্বার্থ সংরক্ষণ করে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১১. কোনও ধরনের সন্ত্রাসবাদকে মদদ না দেয়া এবং কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেয়া।
১২. সর্বনিম্ন আয়ের নাগরিকদের মানবিক জীবন নিশ্চিত করে, আয়ের বৈষম্যের অবসানকল্পে অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ এবং শ্রমজীবী জনগণের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা। সারা দেশে বিদুৎ ও জালানি নিশ্চিত করা। স্নাতক ও সমমান পর্যন্ত শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা।
এর আগে বিকেল ৩টায় কোরআন তিলয়াওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানির সঞ্চালনায় জনসভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, জমির উদ্দীন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড.আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস-চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মো:শাজাহান, শামসুজ্জামান দুদু, ডা:এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জয়নুল আবদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, শওকত মাহমুদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জয়নুল আবদিন ফারুক, আবুল খায়ের ভূইয়া, হাবিবুর রহমান হাবিব, ডা:ফরহাদ হালিম ডোনার, ফজলুর রহমান, আতাউর রহমান ঢালী, মাহবুব উদ্দীন খোকন, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মজিবুর রহমান সরোয়ার, খায়রুল কবির, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বক্তব্য রাখেন।
এছাড়াও সমাবেশে বিলকিস জাহান শিরীন, শামা ওবায়েদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ, সহ-দফতর সম্পাদক মুনির হোসেন, তাইফুল ইসলাম টিপু, টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি কৃষিবিদ শামসুল আলম তোফা, যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, সাধারণ সম্পাদক আব্দু কাদির ভূইয়া জুয়েল ও ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
এর আগে জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে রবিবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট হয়ে সোহরাওয়ার্দী অভিমুখে দলের নেতাকর্মীদের ঢল নামে। সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্র করে শাহবাগ, মৎসভব্ন, হাইকোর্ট, দোয়েল চত্বর ও টিএসসি এলাকাগুলোতে জনজোয়ার দেখা যায়।
এদিকে বিএনপির জনসভা চলাকালীন রাজধানীর একাধিক স্থান থেকে কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। জনসভাস্থল শাহবাগ এলাকা থেকেও কয়েকজন যুবককে আটক করা হয়।