মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বাণী

মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বাণী

বাংলাদেশ সংবাদ- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল মহান ‘শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২১’ উপলক্ষ্যে নিম্নোক্ত বাণী প্রদান করেছেন :
“মহান শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাসহ বিশ্বের সকল ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষকে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। বাংলাদেশের সঙ্গে ইউনেস্কো ২০০০ সাল থেকেই এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করে আসছে। প্রতিবছরের মতো এবারও তারা এ দিবসটির জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, যার মর্মার্থ হলো, ‘শিক্ষায় এবং সমাজে বহুভাষার অন্তর্ভুক্তি সযত্নে লালন করি’, যা আমার বিবেচনায় অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে।
বাঙালি মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা-আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা/রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়। ১৯৫২ সালের এ দিনে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ-উৎসর্গ করেছিলেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ আরও অনেকে। এ দিনে আমি বাংলাসহ বিশ্বের ভাষা-শহিদগণের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি বাংলাভাষার মর্যাদাপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল ভাষাসৈনিককে, যাঁদের দূরদর্শী ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের মা, মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা হয়েছে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ বাঙালির গৌরবময় ঐতিহাসিক দলিলে ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো কালে-কালে আমাদের জাতীয় জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। এতদঞ্চলের শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের স্বার্থসুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি অর্জনের পেছনে রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস। জাতির পিতা ভাষা-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বারবার কারাবরণ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষাসম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ গৃহীত হয়। ঢাকায় এ খবর পৌঁছালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। এর কিছুদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিভাগের ছাত্র শেখ মুজিব তাঁর সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলে এক সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে খাজা নাজিমুদ্দিন আইনপরিষদে ঘোষণা দেয়, পূর্ববাংলার জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু নাজিমুদ্দিনের এই হঠকারী সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করতে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস এবং অন্যান্য দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবসহ অনেক ভাষাসৈনিক সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার হন এবং ১৫ মার্চ মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনরায় ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদভবন ঘেরাও করে, এখানে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকেই আহত হন। ২১ মার্চ জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে এবং উর্দুর স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখে। ২৪ মার্চ কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলে, ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে।
ভাষা-আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপদান করতে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সফরসূচি তৈরি করে ব্যাপক প্রচারনায় অংশগ্রহণ করেন এবং সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর থেকে গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল আবার গ্রেফতার হয়ে জুলাই মাসে মুক্তি পান। এরপর তিনি ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হলে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। প্রসঙ্গতই শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থেকেও ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং আন্দোলনকে বেগবান করার নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ৩ ফেব্রুয়ারি তিনজন দূত মারফত খবর পাঠান, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডাকতে হবে এবং মিছিল করে ব্যবস্থাপক পরিষদের সভাস্থল ঘেরাও করতে হবে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলশেষে এই ঘোষণা জানিয়ে দেয়া হয়। এইপর্যায়ে শেখ মুজিব আমরণ-অনশন ঘোষণা করলে ১৬ ফেব্রুয়ারি কারাকর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের জন্য নির্ধারিত ছিল। শেখ মুজিবের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী ঐদিন সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। পরিস্থিতি-মোকাবিলার জন্য মুসলীম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকাশহরে একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি এবং সকল প্রকার সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে এবং পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে কতগুলো তাজাপ্রাণ নিমেষেই ঝরে যায়, অনেকে আহত হন, অনেকে গ্রেফতার হন। প্রাদেশিক পরিষদের কয়েকজন সদস্য অধিবেশন কক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। উপায়ন্তর না দেখে সরকার সেনাবাহিনী তলব করে, কারফিউ জারি করে এবং প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাভাষার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট নৌকাপ্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ সদস্যগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এরই মধ্যে ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্ণর ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। শেখ মুজিবসহ সকল নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হন। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়, প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং এইদিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। সেই সরকারই শহিদ মিনার তৈরি, বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্য-বিজ্ঞানের বইপ্রকাশ এবং বাংলা টাইপ-রাইটার উদ্ভাবনের জন্য প্রথম প্রকল্প গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্য, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির ফলে সেই আকাঙ্ক্ষাগুলো আর পূরণ হয়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা সকল দাপ্তরিক কাজে বাংলাভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন। বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। আমাদের সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে কানাডাপ্রবাসী রফিক এবং ছালাম নামে দু’জন বাংলাদেশি কয়েকজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য মিলে ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব প্রেরণ করে। যেহেতু জাতিসংঘ ব্যক্তি-প্রস্তাব আমলে নেয় না, তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে প্রেরণ করার পরামর্শ দেয়। তখন আমাদের হাতে সময় ছিল না, আমরা মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’র সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর দ্রুত ফ্যাক্সবার্তার মাধ্যমে ইউনেস্কোকে আমাদের প্রস্তাব প্রেরণ করি। আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে সদস্যরাষ্ট্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন আদায় করি। যার ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আমরা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছি। বিলুপ্তপ্রায় ভাষাসংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদারক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তন করেছি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে যেন বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়। একটি বিশেষমহল বাংলাভাষার মর্যাদাপ্রতিষ্ঠায় এবং বাঙালিসত্তার বিকাশে জাতির পিতার অবদানকে মুছে ফেলতে সবসময়ই তৎপর। জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা শাখার গোপনদলিল প্রকাশের মধ্য দিয়ে সে সকল অপতৎপরতা রুখে দেয়া সম্ভব হয়েছে।
আমরা যে চেতনায় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি এবং একই চেতনায় স্বাধীনতা-অর্জন করেছি। সেই চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে গত ১২ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়ের রোল মডেল। আমরা ২০২০-২১ সাল মুজিববর্ষ উদযাপন করছি। আগামী মাসে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবো। ২০২১-২০৪১ পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত-পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি এবং ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। ইনশাআল্লাহ, অচিরেই আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করবো।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।”

Comments are closed.

More News...

পুরুষের কাজের প্রেরণা তার প্রিয়তমা …….লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল

মুহম্মদ আলতাফ হোসেন একজন সৃজনশীল মানুষ ছিলেন