কবির হোসেন রাজধানীর খিলগাঁও থানার নাসিরাবাদ ইউনিয়নের নাসিরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। শুকনো মৌসুমে সড়ক দিয়ে এলাকায় চলাফেরা করতে পারলেও বর্ষা মৌসুমে নৌকাই তাঁর পরিবারের একমাত্র ভরসা। তাঁর পুরোনো নৌকা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি গতকাল রোববার গিয়েছিলেন নাসিরাবাদ ইউনিয়নের বালুরপার গ্রামের কায়েতপাড়া বাজারের নৌকার হাটে।
ঢাকার নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য প্রতি বৃহস্পতিবার কায়েতপাড়া বাজারে বসে নৌকার হাট। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই হাট চলে। বৃহস্পতিবার ছাড়াও প্রতিদিন সেখানে নৌকা বেচাকেনা হয়। নৌকার হাটে নৌকা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। নৌকা কেনার পর নৌকায় করেই সেটি পরিবহন করতে হয়। হাটে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে নৌকা বাঁধা। দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা এই হাটে আসেন নৌকা কিনতে।
কায়েতপাড়া বাজারের নৌকা তৈরির তিন-চারজন কারিগরের সঙ্গে কথা হয় গতকাল। তাঁরা বলেন, ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে নৌকার হাট বসছে। এটিই ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো নৌকার হাট।
নৌকার কারিগরেরা জানান, বর্ষা মৌসুমে ঢাকার বিভিন্ন নিচু এলাকা ডুবে হয়ে যায়। সে সময় নৌকাই হয়ে ওঠে সেসব এলাকার বাসিন্দাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। এ ছাড়া অনেকে ঢাকার আশপাশে বাড়ি বানিয়েছেন, কিন্তু এখনো রাস্তা হয়নি। তাঁরাও বর্ষাকালে নৌকার ওপর নির্ভরশীল। আবার নিম্নাঞ্চলের অনেক লোক মাছ ধরার জন্যও নৌকা কেনেন।
নৌকা ব্যবসায়ীরা বলেন, কায়েতপাড়া বাজারে মূলত ১৬ থেকে ১৮ ফুটের মাঝারি আকারের নৌকা বেশি তৈরি হয়। এই আকারের প্রতিটি নৌকা তৈরি করতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে। প্রতিটি নৌকা বানাতে দুজন কাজ করেন। একজন শ্রমিক একটি নৌকা তৈরিতে পারিশ্রমিক পান ৪০০ টাকা। অনেকে শুধু বর্ষাকালে চার-পাঁচ মাসের জন্য মৌসুমি ব্যবসা করেন।
২০-২৫ জন শ্রমিক কায়েতপাড়া বাজারে নৌকা তৈরির কাজ করেন। মো. আল আমিন নামের একজন নৌকার কারিগর বলেন, আগে সপ্তাহে হাটে প্রায় দেড় শ নৌকা বিক্রি হতো। এখন বিভিন্ন জায়গা ভরাট করে ফেলায় নৌকার বিক্রি কমেছে।
কারিগর ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নৌকা তৈরির জন্য কাঠ আসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাব থেকে। নৌকার মূল কাঠামো তৈরি করা হয় কেরোসিন কাঠ দিয়ে। আর গজারি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয় বইঠা। ১৬ ফুটের একটি নৌকা বানাতে প্রায় আট হাজার টাকা খরচ হয়। ভালো মানের একটি নৌকার দাম পড়ে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। বর্ষাকালে প্রতি সপ্তাহে ৫০-৬০টি নৌকা বিক্রি হয়। নৌকা কেনার পর ক্রেতাদের বাজারের ইজারাদারকে প্রতি হাজারে ১০০ টাকা করে দিতে হয়।
মোহাম্মদ আলকাস নামের একজন নৌকা ব্যবসায়ী বলেন, ‘৪০-৫০টি নৌকা বিক্রি করে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় হয়। এখানে অন্য ব্যবসার সুযোগ কম। রাস্তা নাই। দোকান দিলে চলে না। ট্রলার দিয়ে যাতায়াত করা লাগে।’
কায়েতপাড়া হাটের ইজারাদার কাজী গরীব উল্লাহ তিন অর্থবছর ধরে এই হাটের ইজারা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, এই নৌকার হাটে বাড্ডা, সাতারকুল, ডেমরা, মুড়াপাড়া ও রূপগঞ্জ থেকে ক্রেতা আসেন। তবে এখন হাট আগের মতো জমে না। আগে নৌকা তৈরির জন্য অনেক শ্রমিক ছিলেন। এখন তাঁরা বিভিন্ন দিকে চলে গেছেন।