সবার শেষে বাসে উঠলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সকাল থেকেই কার্ডিফের পার্ক প্লাজা হোটেলের সামনে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ভিড়। সারি সারি টেলিভিশন ক্যামেরা। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লেন অধিনায়ক—বার্মিংহামে দেখা হবে!
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ঠিক করা ছিল, বাংলাদেশ দল এদিন বার্মিংহাম যাবে। বার্মিংহাম তো যাবে, তবে টিম বাস বার্মিংহাম এয়ারপোর্টে যাবে, না বার্মিংহামের হোটেলে—এটাই ছিল প্রশ্ন। এই বাস হোটেলেই যাচ্ছে। বাংলাদেশ যাচ্ছে সেমিফাইনাল খেলতে। বাংলাদেশের অতি আবেগময় সমর্থক ছাড়া আর কেউই যা ভাবেননি।
তাসকিন আহমেদ অবশ্য দাবি করছেন, তিনি ভেবেছিলেন। বাসে ওঠার আগে বললেন, ‘আমি ইংল্যান্ডে এয়ারপোর্টে নেমেই বলেছিলাম, আমরা সেমিফাইনাল খেলব। ফাইনালও খেলব ইনশা আল্লাহ।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে তাসকিন বাসে উঠতে যাবেন। রাস্তার ওপার থেকে দৌড়ে এলেন মধ্যবয়সী এক মহিলা। এসে জড়িয়ে ধরলেন তাসকিনকে। বিব্রত তাসকিনের গালে বসিয়ে দিলেন একটা চুমুও। রাস্তার ওপারে বসে থাকা ওই মহিলার বান্ধবীরা তুমুল হাততালি দিচ্ছেন।
এ ঘটনাকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ কেমন আলোড়ন তুলেছে, তার একটা প্রমাণ হিসেবে দেখতে পারেন। কিন্তু সেটি ভুল হবে। ওই মহিলা ক্রিকেটের কোনো খোঁজখবরই রাখেন না। টিভি ক্যামেরার ভিড় দেখে মজা করে ওই কাণ্ডটা করেছেন। তবে তাসকিন যে খুব সুদর্শন, সেটা বুঝতে তো আর ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখতে হয় না। হাসতে হাসতে সেটিই বললেন কৌতূহলী সাংবাদিকদের।
তাসকিনের ঘটনাটা নিয়ে সতীর্থরা বেশ মজা করলেন। এ এমন এক আনন্দযাত্রা, যেকোনো কিছুতেই মজার উপকরণ খুঁজে পাওয়া যায়। আর এটা তো আসলেই মজার ঘটনা। মাঝখানে খাওয়ার জন্য আধঘণ্টার বিরতিসহ কার্ডিফ থেকে বার্মিংহামে প্রায় তিন ঘণ্টার বাসযাত্রায় অবশ্য সেমিফাইনালে ওঠা নিয়ে কোনো উদ্যাপনের খবর পাওয়া গেল না। কার্ডিফে টিম হোটেলে পরশু রাত আর কাল সকালে দেখা চিত্রের সঙ্গে তাহলে কোনো পার্থক্য নেই। ক্রিকেটাররা ভেতরে ভেতরে অবশ্যই রোমাঞ্চিত, কিন্তু সেটির তেমন প্রকাশ নেই। বাসে ফিজিওর ল্যাপটপে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ চলছিল। মাঝেমধ্যে সেটিতে উঁকি দিয়ে ম্যাচের সর্বশেষ অবস্থা জেনে নিলেন অনেকে। সেমিফাইনালে বাংলাদেশকে খেলতে হবে ‘বি’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে। যা চূড়ান্ত হবে আজ পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পর। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৯১ রানে অলআউট করে দিয়ে ভারত সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ততক্ষণে।
১৫ তারিখ যে মাঠে সেমিফাইনাল, হোটেলের বদলে বার্মিংহামে বাংলাদেশ দলের বাস গিয়ে থেমেছে সেই এজবাস্টনের সামনে। শহরে কী একটা সাইকেল রেস হচ্ছে, বড় বাস যাওয়ার রাস্তা সব বন্ধ। এজবাস্টন থেকে ক্রিকেটাররা তাই কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে আইসিসির পাঠানো জিপে করে হোটেলে পৌঁছেছেন। সেখানে যাওয়ার পর যে যাঁর রুমে। বার্মিংহামের হায়াত রিজেন্সি সবার আগে থেকেই চেনা। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশ এই হোটেলেই ছিল।
বাংলাদেশের অনেকে কল্পচোখে অস্ট্রেলিয়া হেরে যাওয়ার পর কার্ডিফে টিম হোটেলে উৎসব দেখে ফেলেছেন। আদতে যা একদমই হয়নি। গত পরশু বিকেলে মাশরাফি বিন মুর্তজা টেলিভিশন সাংবাদিকদের সেমিফাইনালে ওঠার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ওপরে গেলেন। মিনিট দশেক পর তাঁকে ফোন করে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সবাই মিলে নিশ্চয়ই খুব আনন্দ করছেন?’ মাশরাফি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তো আমার রুমে। প্লেয়ারদের বেশির ভাগই তো বাইরে।’
মোস্তাফিজুর রহমানও বাইরে ছিলেন। ইন্টারনেটে অবশ্য খেলার খোঁজখবর রাখছিলেন। এমনিতে আড্ডা মারার সময় খুবই প্রাণোচ্ছল। কিন্তু সাংবাদিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কথা বলার সময় মোস্তাফিজের কথা আটকে যায়। সেমিফাইনালে ওঠার প্রতিক্রিয়া যেমন ‘ভালো লাগছে’তেই শেষ হয়ে গেল। এত সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া? মোস্তাফিজ হাসলেন, ‘আর কী বলব! আমরা সেমিফাইনাল খেলছি, অনেক বড় ব্যাপার।’
আসলেই বড় ব্যাপার। হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড়। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তো তা-ই মনে করেন। গত পরশু এজবাস্টনে বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণী খেলার শেষটা হোটেলের মিটিং রুমে বসে দেখেছেন। ক্রিকেটারদের মধ্যে তাঁর সঙ্গে ছিলেন শুধু মুশফিকুর রহিম। সেমিফাইনালে ওঠার উদ্যাপনটা তাই দুজন মিলেই করেছেন। পনেরো-বিশ মিনিট পর হোটেলের সামনে মাশরাফিকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে।
এটা যে কত বড় ব্যাপার, ক্রিকেটারদের দেখে তা না বোঝা গেলেও চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে দেখে ঠিকই বোঝা যাচ্ছে। খুশিতে রীতিমতো ঝলমল করছেন। কাল সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে তাঁর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথোপকথন হলো এ রকম—
* এটি (বাংলাদেশের সেমিফাইনালে উঠে যাওয়া) কত বড়?
হাথুরুসিংহে: (অবাক হয়ে) সবচেয়ে বড়। এর চেয়ে বড় কিছু তো আর আগে হয়নি।
* কেন, ২০১৫ বিশ্বকাপ?
হাথুরুসিংহে: সেটি ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল আর এটি সেমিফাইনাল।
ঠিকই তো!