দামি জামদানি কেন লুকিয়ে রাখেন তাঁতি?

দামি জামদানি কেন লুকিয়ে রাখেন তাঁতি?

অফ হোয়াইট আর সোনালি জরির কাজ করা একটা জামদানি দেখাচ্ছিলেন বিক্রেতা। বলছিলেন, ‘নেন বা না নেন, শাড়িটা দেখেন। মিহি সুতা, পুরা শাড়িতে কাজ। ঠকবেন না।’ ক্রেতা দম্পতি দাম জানতে চাইলেন। বিক্রেতা জানিয়ে দিলেন, শাড়িটি নিতে হলে গুনতে হবে ২০ হাজার টাকা।

পাশে দাঁড়িয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার এমন কথোপকথনের মধ্যে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই দোকানের সবচেয়ে দামি জামদানি কোনটা?’ বিক্রেতা বললেন, ‘লাখ টাকা দামের জামদানি আছে আমাদের দোকানে।’ একটু দেখাবেন বলতেই প্রথমে একটু ইতস্তত করলেন, তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে যক্ষের ধনের মতো একটা অফ হোয়াইট জামদানি শাড়ি বের করলেন। তবে ভাঁজ খুললেন না। দেখানো তো পরের কথা! দ্রুতই আবার শাড়িটা যথাস্থানে রেখে দিলেন। এরপর এই শাড়ি, ওই শাড়ি দেখতে বললেও এক লাখ টাকা দামের জামদানিটা নিয়ে আর কোনো কথা বললেন না।

ক্রেতার জন্য অপেক্ষায় আছে ২৬টি স্টলের আড়াই হাজার থেকে লাখ টাকার সুন্দর সুন্দর জামদানি। ছবি: প্রথম আলোএই ঘটনা গত শনিবারের—রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে চলা জামদানি প্রদর্শনীর ‘ইসমাইল জামদানি’ স্টলের। এখান থেকে গেলাম ‘রুমা জামদানি’ স্টলে। দোকানের সবচেয়ে দামি জামদানি নিয়ে জানতে চাইলে জাতীয় স্বর্ণপদক পাওয়া বুননশিল্পী মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার দোকানে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দামের জামদানি আছে।’ দেখতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শাড়িটা দোকানে রাখিনি। কেউ নিতে চাইলে আনব।’

‘পূর্ণতা জামদানি’ স্টলে গিয়ে দামি জামদানির সন্ধান করতেই বিক্রেতা ৬৫ হাজার টাকা দামের একটা শাড়ি বের করলেন। দামি আর সুন্দর শাড়িটা ডিসপ্লেতে রাখেননি কেন?—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাইরে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। তাই রাখিনি।’ তবে ‘ইউসুফ জামদানি ঘর’-এর তাঁতির কথা শুনে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম, কেন দামি জামদানি তাঁতিরা দেখাতে চাইছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই তাঁতি বলেন, ‘কেউ দোকানের সবচেয়ে ভালো আর দামি জামদানিটা ডিসপ্লেতে রাখবে না। নকল হয়ে যাবে না!’

জাতীয় জাদুঘরে এই জামদানি প্রদর্শনী চলবে ২২ জুন পর্যন্ত। ছবি: প্রথম আলো‘ঝর্ণা জামদানি’ স্টলে গিয়ে সরাসরি জানতে চাইলাম, ‘নিশ্চয় সবচেয়ে দামি জামদানিটা দেখাবেন না!’ এক গাল হেসে তাঁতি মো. মনির হোসেন বললেন, ‘লাখ টাকার আসল জামদানি আসলে কেউ মেলায় আনে না। মেলায় এত দামি জামদানি বিক্রি হয় না। তবে আপনারে এটা-সেটা দেখিয়ে বলতে পারে, শাড়িটার দাম লাখ টাকা। আসলে এত দাম না। এমন দামি জামদানি যাঁরা কেনেন, তাঁরা আগে থেকেই তাঁতির সঙ্গে যোগাযোগ করে নকশা পছন্দ করে অর্ডার দেন। তারপর তাঁতির কাছ থেকেই সংগ্রহ করেন।’

এমন কথার সত্যতা পাওয়া গেল ‘জিয়াসমীন জামদানি’ স্টলের তাঁতি গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানালেন, তাঁরা দেড় লাখ টাকার জামদানি বানিয়েছিলেন মেলা উপলক্ষে। তবে সেটা এখানে আনার আগেই বিক্রি হয়ে গেছে, ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। কোথায় বিক্রি করলেন?—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু ক্রেতা আছেন, যাঁরা নকশা দেখে পছন্দ করে অর্ডার করেন। বানানোর পর শাড়িটি তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’ ক্রেতা তো এই প্রদর্শনীতে এসেও কিনতে পারতেন—প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, ‘এখানে এমন শাড়ি দেখালে কপি হয়ে যাবে। এত দাম দিয়ে যিনি জামদানি কেনেন, তিনি চান না তাঁর শাড়ির মতো আরেকজনের শাড়ি হোক।’

দামি জামদানিটা আড়ালে রাখেন বিক্রেতারা। তবে প্রকৃত ক্রেতার হাতে ঠিকই চলে যায় সেটা। এ জন্য অবশ্য তাঁদের মেলায় আসতে হয় না। ছবি: প্রথম আলোদামি জামদানি তাঁতিরা কেন লুকিয়ে রাখেন—এর একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিলেন আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (বিপণন) রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, এবারের মেলায় বেশ কয়েকটি দোকান এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার জামদানি এনেছে। তবে এগুলো ডিসপ্লেতে রাখেন না বা দেখাতে চান না। কারণ, এখানে সবাই তাঁতি। দামি শাড়িটা একবার দেখলেই দক্ষ তাঁতিদের যে-কেউ সেটা বুনে ফেলতে পারবেন। কষ্টের নকশাটা কপি হয়ে যাক, তাঁতিরা সেটা চান না। তাই হয়তো এ-ই লুকোচুরি!

১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে ২২ জুন পর্যন্ত, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। ক্রেতার জন্য অপেক্ষায় আছে ২৬টি স্টলের আড়াই হাজার থেকে লাখ টাকার সুন্দর সুন্দর জামদানি।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::