আরেকটি পাকিস্তানি রূপকথা

আরেকটি পাকিস্তানি রূপকথা

কে না জানে, ক্রিকেট বিস্ময় উপহার দিতে ভালোবাসে। তাই বলে এতটা?

কে না জানে, ক্রিকেটের পাকিস্তান ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার মতো। কখন কী হবে, কেউ বলতে পারে না। তাই বলে এমন কিছু?

কাল ওভালে যা হলো, তা নিছকই আরেকটা ক্রিকেট ম্যাচ নয়। ব্যাখ্যার অতীত কিছু! ক্রিকেটের রহস্যপ্রিয়তা, পাকিস্তানের ক্রিকেটের অননুমেয় চরিত্র মনে রেখেও যেটি বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের সীমারেখা মুছে দিতে চায়। দুদিন ধরে লন্ডনে প্রচণ্ড গরম। ঠাঠা রোদে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির এই ফাইনাল, যা দেখতে দেখতে কারও মনে সংশয় জাগতেই পারত—যা দেখছি, তা সত্যি তো? নাকি তীব্র রোদে চোখের ধাঁধা?

র‍্যাঙ্কিংয়ে ৮ নম্বর হিসেবে সুযোগ পাওয়া পাকিস্তান, প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে উড়ে যাওয়া পাকিস্তান ৩৩৮ রান করে ফেলেছে আর সেটির জবাবে বিশ্বের সেরা ব্যাটিং লাইনআপ ৫ উইকেটে ৫৪! এর মিনিট পাঁচেক পর ওভালের বাইরে উঁকি দিলে কারও মনে হতেই পারত, ফাইনাল ম্যাচটা একটু আগে শেষ হয়ে গেল। নইলে ঘরমুখী দর্শকের এমন স্রোত কেন?

ফাইনাল আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে আরও অনেক পরে। অভাবনীয় এক প্রাপ্তির আনন্দে আত্মহারা পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা যখন মাঠে দৌড়াচ্ছেন, গ্যালারি তখন অর্ধেকেরও বেশি খালি। চোখের সামনে যা হচ্ছে, তা সহ্য করতে না পেরে ভারতীয় দর্শকেরা যে বেরিয়ে গেছেন আগেই। সবচেয়ে বড় অংশটা ৫ উইকেট পড়ার পরই।

পাকিস্তানকে ট্রফিটা চাইলে তখনই দিয়ে দেওয়া যেত। ৭২ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর তো আরও। এরপর পান্ডিয়া ও জাদেজার ৮০ রানের জুটি ম্যাচটা শুধু একটু লম্বাই করতে পেরেছে। ভারত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তৃতীয় শিরোপা জিতছে, না পাকিস্তান প্রথম—এই প্রশ্ন একবারের জন্যও ওঠেনি। পান্ডিয়া যখন একের পর এক ছক্কা মারছেন, তখনো না। ওই প্রশ্ন অনেক আগেই মীমাংসিত।

বলতে পারেন মোহাম্মদ আমিরের ৫ ওভার পরেই। সাত বছর আগে এই ইংল্যান্ডেই স্পট ফিক্সিংয়ের পাঁকে ডুবে যাওয়া বাঁহাতি ফাস্ট বোলারের নামের পাশে তখন ৫-১-১৬-৩! ৯ ওভার শেষে ভারত ৩ উইকেটে ৩৩। সেই ৩ উইকেট ভারতের প্রথম ৩ ব্যাটসম্যান, যাঁরা আগের ম্যাচগুলোতে পরের ব্যাটসম্যানদের বলতে গেলে নামতেই দেননি।

চোটের কারণে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালটা খেলতে পারেননি। ফাইনালে আমিরই ভালো হবেন, না তাঁর বদলে সুযোগ পেয়ে ভালো বোলিং করা রুম্মান রইস—এ নিয়ে কথা শোনা গেছে। যা থামিয়ে দিতে আমির একদমই সময় নেননি। নির্দিষ্ট করে বললে ৩ বল। এই টুর্নামেন্টে ভারতের দুই ওপেনারই বলতে গেলে অনেক ম্যাচ শেষ করে দিয়ে এসেছেন। আর এদিন উদ্বোধনী জুটিতে কিনা শূন্য!

আমির ভারতের বুকে মরণ শেলটা হানলেন পরের ওভারে। রোহিত-ধাওয়ানরা যতই রান করুন, পাকিস্তান ভালো করেই জানত, পথের আসল কাঁটা বিরাট কোহলি। ৩৩৮ রানের পাহাড়ও যাঁর সামনে নিরাপদ নয়। প্রথম স্লিপে আজহার আলী যখন কোহলির ক্যাচ ফেললেন, আলোচনা শুরু হয়ে গেল, ট্রফিটাই তিনি ফেলে দিলেন না তো! বুদ্‌বুদ তোলার আগেই যা মিলিয়ে গেল। পরের বলেই যে কোহলিকে ফিরিয়ে দিলেন আমির।

বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর সঙ্গে নাম উচ্চারিত হয় আরও দু-তিনজনের। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটকে আলাদা করে নিলে কোহলির প্রতিদ্বন্দ্বীরা কয়েক মাইল পেছনে। সেই কোহলির গায়েই বড় একটা অপবাদ আরও বেশি করে লেগে গেল। তিনি ফাইনালের চাপ নিতে পারেন না। ৮টি ফাইনালে ব্যাটিং গড় মাত্র ২২। সেঞ্চুরি দূরে থাক, একটা ফিফটি পর্যন্ত নেই।

যেখানে কোহলির মতো মহাতারকাকে ছাপিয়ে উজ্জ্বল অখ্যাত এক পাকিস্তানি ওপেনার। নাম ফখর জামান। এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। সেটিও ২৭ বছর বয়সে। পাকিস্তানি মানদণ্ডে রীতিমতো ‘বুড়ো’! সেই ফখর জামান জীবনের প্রথম ফাইনাল খেলতে নেমে নিজের ব্যাটে সেটির ভাগ্য লিখে দিলেন।

ভাগ্য! ক্রিকেটে ভাগ্য কখনো কখনো ব্যাপার হয়ে ওঠে। তবে সেটির ছোঁয়া পেলে তা কাজে লাগাতে জানতে হয়। কোহলি যা পারেননি। ফখর জামান পেরেছেন। ৩ রানেই কট বিহাইন্ড হয়ে গিয়েছিলেন। ড্রেসিংরুমের দিকে অনেকটা পথ চলে যাওয়ার পর তাঁকে ফিরিয়ে আনল বুমরার নো বল। পাকিস্তানের ইনিংসের তখন চতুর্থ ওভার। স্কোর মাত্র ৮।

আজহার আলীর সঙ্গে ফখর জামানের যে উদ্বোধনী জুটি ৮ রানেই ভেঙে যাওয়ার কথা, সেটি কিনা ভাঙল ১২৮ যোগ করে ফেলার পর! সেটিও ভারতীয় কোনো বোলারের কৃতিত্বে নয়। আজহার রানআউট হয়ে যাওয়ায়। সেই রানআউটে নিজেরও দায় আছে ভেবে অপরাধবোধের কারণেই কিনা, ফখর জামানের ব্যাট ঝলসে উঠল এরপর। ১০৬ বলে ১১৪ রান করে যখন আউট হলেন, রানের পাহাড়ে ওঠার পথ অনেকটাই পেরোনো হয়ে গেছে। ৩৩ ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে ২০০।

শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান যেখানে থামল, জিততে হলে ভারতকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়তে হতো। ওভাল মাঠের রেকর্ডও। কঠিন, কিন্তু অসম্ভব কেন হবে! কদিন আগে এই ওভালেই কি ভারতের ৩২১ রান তাড়া করে জেতেনি শ্রীলঙ্কা! ভারতের ব্যাটিং লাইন তো আরও তারকাখচিত। ৩৩৯ কেন সম্ভব নয়?

এ নিয়ে যা কথাবার্তা, তা দুই ইনিংসের মাঝের সময়টাতেই। ভারতের ইনিংস শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই যা কর্পূরের মতো বাতাসে উবে গেল। পাকিস্তান ক্রিকেটের আরেকটি রূপকথা যে লেখা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে!

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::